তোফাজ্জল-আবরার-বিশ্বজিৎ হত্যা -মোহাম্মদ নবী আলম

বিশেষ প্রতিনিধি

বিশেষ প্রতিনিধি

অক্টোবর ১, ২০২৪ ৫:১৩ অপরাহ্ণ

মানুষকে বলা হয় “আশরাফুল মাখলুকাত” বা সৃষ্টির সেবা জীব। মহান আল্লাহ্ তাআলা মানুষকে সৃষ্টির সেরা হিসেবে মনোনীত করেছেন। মানুষের আছে মনুষ্যত্ব, জ্ঞান-বৃদ্ধি, বিবেক-বিচেনা, এগুলো দিয়ে একজন মানুষ ভালো-মন্দ বিচার করেন। যার মনুষ্যত্ব নাই, সে মানুষরূপী অমানুষ। অমানুষ কখনো ভালো-মন্দ বিচার করতে পারে না। যেমন, বনের জন্তু। আমরা মাঝে মধ্যেই জন্তুর প্রতিচ্ছবি মানুষরূপী অমানুষের আচরণ ও কার্যকলাপে দেখতে পাই। সম্প্রতি দেশবাসী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের আর্শীবাদে জন্তুর প্রতিচ্ছবি দেখতে পান প্রাচ্যের অক্সফোর্ড ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলের কয়েকজন শিক্ষার্থীর মাঝে। যা দেখে বিবেকবান মানুষ হতাবাক হয়েছে। যারা মোটেও হতবাক হননি, তারা বিবেকহীন মানুষ। বিবেকহীন মানুষ মৃত মানুষের সমতুল্য।

স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিক বরগুনার পাথরঘাটার সন্তান তোফাজ্জল। এলাকায় তিনি অত্যন্ত সজ্জন, পরিচ্ছন্ন ও বিনয়ী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। মৃত্যুর আট বছর আগে সড়ক দুর্ঘটনায় বাবাকে হারান। চার বছর আগে ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মা মারা যান। গত বছর পনেরো রোজায় লিভার ক্যান্সারে মারা যান বড় ভাই। চোখের সামনে বাবা, মা ও বড় ভাইয়ের মৃত্যুতে তোফাজ্জল মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েন। সেই থেকে শুরু হয় তার ভবঘুরে জীবন। তোফাজ্জলকে মাঝে মধ্যে পাথরঘাটা দেখা গেলেও অধিকাংশ সময় তিনি লাপাত্তা থাকতেন। পাথরঘাটার অনেকে তোফাজ্জলকে উদ্যোম শরীরে, কখনো নোংরা পোষাকে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে ঘুড়াঘুড়ি করতে দেখেছেন। এমন একজন মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করলো ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের বিবেকহীন কয়েক শিক্ষার্থী। তোফাজ্জলের অপরাধ তিনি সন্দেহভাজন একজন মোবাইল চোর। আরও অপরাধ পাগল হলেও ফোন নম্বর মনে রাখতে পারা। তার চেয়েও বড় অপরাধ, ক্যান্টিনের খাবারের মান ভালো বলা। মৃত্যুর আগে মানুষের হয়তো খাবারের স্বাদ অমৃত লাগে। এই খাবার জীবনের শেষ খাওয়া হবে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন কিনা জানি না। খাবার হজমও করতে পারলেন না, তার আগেই মারধর করে হত্যা করলেন ফজলুল হক মুসলিম হলের কয়েকজন ছাত্র। ইতিহাসের পাতায় ফজলুল হক মুসলিম হলের ছাত্রদের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। তোফাজ্জলকে হত্যার কারণে নয়, বরং তাদের উদার মানবিকতায়। তোফাজ্জলকে হত্যার আগে শেষ বারের মতো ভাত ও পানি খেতে দিয়েছিলেন।

২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ছাত্র আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যা করেন বুয়েট ছাত্রলীগের একদল নেতা-কর্মী। আবরারের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ, তিনি ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের পানি ও গ্যাস চুক্তির বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করে ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন। এই অপরাধে আবরারকে সাত-আটজন ছাত্রলীগ নেতা শেরেবাংলা হলের একটি কক্ষে ক্রিকেট স্টাম্প আর স্কিপিং রোপ দিয়ে দফায় দফায় বেধড়ক পিটিয়ে হত্যা করে। আবরারকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যার খবরে ব্যথিত হয় বাংলাদেশের মানুষ।

চব্বিশ বছরের যুবক বিশ^জিৎ ছিলেন দর্জি দোকানের কর্মচারী। বাড়ি শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার মশুরা গ্রাম। ২০১২ সালের ৯ ডিসেম্বর। প্রতিদিনের মত রাজধানীর লক্ষ্মীবাজারের বাসা থেকে শাঁখারী বাজারের কর্মস্থলে যাচ্ছিলেন বিশ্বজিৎ। তৎকালীন সরকারের কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদে বিএনপির কর্মসূচি চলাকালে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বিশ^জিৎ পৌঁছামাত্র একটি ককটেল বিস্ফোরণ হয়। আতঙ্কে অন্যান্য পথচারীদের মত নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য দৌড়ে পালাচ্ছিলেন বিশ্বজিৎও। কিন্তু রক্ষা পেলেন না। বিরোধী দলের কর্মী সন্দেহে বিশ^জিৎকে বন্য প্রাণী শিকারের মতো ধাওয়া করে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০-১২জন ছাত্রলীগ কর্মী। হত্যাকারীরা রাজপথে, প্রকাশ্য দিবালোকে সাংবাদিক, মানুষ আর ক্যামেরার সামনে বিশ্বজিৎকে কুপিয়ে ও বেদম প্রহার করে নৃশংসভাবে হত্যা করে। বিশ^জিৎকে হত্যার পর হত্যাকারীরা সেদিন আনন্দ মিছিলও করেছিল। তাদের মধ্যে কোনো অনুশোচনা ছিল না। হত্যার নির্দয় দৃশ্য দেখে মানুষ হতবাক হয়ে গিয়েছিল। পত্রিকা, টেলিভিশনে বিশ্বজিৎ এর হত্যাকারী মানুষরূপী হায়েনাদের ছবি সেদিনও দেশের মানুষ দেখেছিল।

তোফাজ্জল, আবরার ও বিশ্বজিৎ হত্যাকারীরা প্রত্যেকেই দেশের ঐতিহ্যবাহী তিনটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র। বিশ^বিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র হয়েও তাদের মধ্যে কোনো মনুষ্যত্ব ছিল না। কেনো মানুষরূপী ওই ছাত্রগুলো অমানুষ হলো। এই প্রশ্ন দেশের সর্বস্তরের মানুষের মনে। এ দায় শুধুই কি হত্যাকারী শিক্ষার্থীদের? সরকার

আরও পড়ুন