রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) এ আলোচনা যেন থামছেই না। একের পর এক থলের বিড়াল বেড়িয়ে আসছে। একজন তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারি তিনিও গড়েছেন সম্পদের পাহাড়। এবার দুদকের জালে আটকা পড়েছেন এই মোমিন । বলছি রাজউকের প্রধান কার্যালয়ে কর্মচারি ডাটা এন্ট্রি অপরেটর আব্দুল মোমিন এর কথা।
দুদক সূত্রে জানা গেছে, রাজউকের এই কর্মচারি ভাদাইল মৌজার হোসেন প্লাজার পূর্বে পাশের দেড় বিঘা জমি কিনে টিনসেড করে ভাড়া দিয়েছেন। যা দিয়ে প্রতি মাসে লাখ লাখ টাকা নিচ্ছেন। এছাড়া তিনি (আব্দুল মোমিন) তার স্ত্রী এবং তার নিজ নামে বিভিন্ন ব্যাংকে শতশত কোটি টাকা জমা আছে।
আরো জানা গেছে, মান্ডা মদিনা টাওয়ারে পাশে ৭ তলা ভবন নির্মান করছেন। মতিঝিল জসিম উদ্দিন রোডে ১৮০০ বর্গফিটের ফ্লাট কিনেছেন যার বর্তমান বাজার মূল্য ২ কোটি ৫০ লাখ টাকা।
এই বিষয়ে দুদকের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করা শর্তে এ প্রতিবেদককে বলেন, এটি এখনো চলমান আছে। তদন্ত শেষ পর্যায়ে । খুব শিগ্রই তিনি সহ বেশ কয়েকজনের প্রতিবেদন দেয়া হবে। শুধু রাজউকে আব্দুল মমিন সাহেব না। তার মত আরো একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী আছেন। যারা অবৈধ সম্পদের মালিক হয়েছেন। আমরা অচিরেই তাদের ধরবো। একটি কথা মনে রাখবেন সরকারি চাকরি মানে জনগনের সেবক। আর সেই সেবা দেওয়ার নামে যারা নিজেদের সুবিধা নিচ্ছেন দুদক বিন্দু পরিমান ছাড় দিবে না। জনগনকে সেবা দেওয়াই হচ্ছে সরকারি কর্মকর্তা- কর্মচারীদের কাজ।
দুর্নীতি দমন কমিশনের ভাষ্য মতে রাজউকের অন্তত ২৫ জন কর্মকর্তা ও কর্মচারির বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ রয়েছে। ইতিমধ্যে কয়েকজনকে গ্রেফতার এবং মামলাও দায়ের করা হয়েছে। তারপরও এই প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি কমছে না।
আব্দুল মোমিনের যত কাণ্ড: আব্দুল মোমিনের রাজউকের চাকরি করার কারণে সবার সাথেই একটি ভালো সম্পর্ক হয়েছে। আর সেই সুযোগে কিছু সহজ সরল মানুষদের কাজ থেকে হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। সম্প্রতি পূর্বাচলে জৈনিক এক ব্যক্তির নিকট থেকে ৭৫ লাখ টাকা নিয়েছেন। ২০২০/২১ সালে নিজের (মোমিন) একাউন্ট থেকে ৪০ লাখ টাকা উঠানো হয়েছে। সেই বছরেই এক এসপি লিখিত অভিযোগ করেন চেয়ারম্যান বরাবর। তিনি অভিযোগে জানান কাজের কথা বলে আব্দুল মমিন ১৫ লাখ টাকা নিয়েছেন। সেটা নিয়ে তদন্ত কমিটি হলে মমিন তদন্ত কমিটির এক কর্মকর্তাকে দিয়ে বিষয়টি ধামাচাপা দিয়েছেন।
এছাড়া আব্দুল মোমিন কোটি কোটি টাকা বানিয়েছেন স্পা সেন্টার দিয়ে। তিনি প্রথমে “ঢাকা স্পা সেন্টার” নামে গুলশানে একটি স্পা সেন্টার খুলেন। এই স্পা সেন্টারের আড়ালে করতেন যৌন ব্যবসা।
অনুসন্ধান জানা যায়, রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন’র আত্মীয় পরিচয় দিয়ে স্পার আড়ালে ছিল তার পতিতা বাণিজ্য। মাদকসহ নানান রকমের অপরাধে লিপ্ত ছিল এই “ঢাকা স্পা সেন্টার”। বিগত সরকারের সময় পুলিশ অভিযান চালালে তার ব্যাবসায়িক পার্টনার মোহন রায় সহ দশজন ধরা পরে।
পরবর্তীতে আবার গুলশান-১ এর নাভানা টাওয়ারে একটি অ্যাপার্টমেন্টে “ঢাকা বডি কুইন স্পা” নামে ঢাকায় উঠতি বয়সের যুবতী ও নারীদের একত্রিত করে অবৈধ দেহ ব্যবসা পরিচালনা ও যৌন শোষণ ও নিপীড়নমূলক কার্যক্রম পরিচালনা করে। পরবর্তীতে পার্টনারের সাথে মনমালিন্য হওয়ায় আলাদা হয়ে যান। আলাদা হওয়ার কারণ ছিল বিভিন্ন সরকারি কর্মকর্তাকে মোমিন এর কাস্টমার হওয়ায় টাকা বেশি আবদার করতেন। এই কারণে মূলত আলাদা পরবর্তীতে বন্ধ হয়ে যায় প্রতিষ্ঠানটি ।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ডাটা এন্ট্রি অপরেটর আব্দুল মোমিন রাজউকের কাজে ফাঁকি দিয়ে বেশ কয়েকটি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের কাজ নিয়েই বেশি ব্যস্ত থাকেন। এছাড়া অর্থের বিনিময়ে প্ল্যান পাশ, প্লট হস্তান্তর, প্লট বিক্রয়ের দালালী, আবাসিক ভবনকে অ-আবাসিক বা বাণিজ্যে রুপান্তর ইত্যাদি কাজ চুক্তির মাধ্যমে করে যাচ্ছেন। এসব কাজ করে তিনি অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছেন। অফিস টাইমে প্রায় সময়েই তার সাথে কিছু ঠিকাদারের গল্প করতে দেখা যায়। তিনি ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের ৭১ ও ৭২ নং ওয়ার্ডের দুইজন প্রভাবশালী নেতার বেশ কয়েকটি বড় বড় প্ল্যান মিথ্যা তথ্যে পাশ করিয়ে দিয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। জাল কাগজপত্র সৃষ্টি করতে তিনি ওস্তাদ বলে জানিয়েছেন রাজউকের কয়েকজন কর্মচারি।
এভাবে অবৈধপথে অর্থ উপার্জন করে সেই অর্থে তিনি রাজধানীর সবুজবাগ থানাধীন মান্ডা ঝিলপাড়ে স্ত্রী ও শ্বাশুড়ীর নামে ৫ কাঠা জমি ক্রয় করেছেন যার মুল্য কমপক্ষে ১০ কোটি টাকা। ঢাকা -মুগদা ৭১ নং ওয়ার্ডের দক্ষিন মান্ডার ১ম গলিতে “শান্তির নীড়” সুলতানা মহল নামে একটি ৬তলা বাড়ী নির্মাণ করেছেন যার মুল্য আনুমানিক ২৫ কোটি টাকা। নিজে ব্যবহারের জন্য একখানা প্রাইভেট কারও ক্রয় করেছেন যার মুল্য কমপক্ষে ২৮ লাখ টাকা। এছাড়া তার গ্রামের বাড়ী সিরাজগঞ্জেও প্রচুর সম্পত্তি ক্রয় করেছেন। এসব সম্পদের বৈধ কোন ইনকাম সোর্স নেই বলে জানা যায়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)-এর একাধিক কর্মকর্তা জানান, তার নামে (আব্দুল মোমিন) কোন সম্পত্তিই রাখেনা। যা আছে সবকিছুই তার আত্মীয়-স্বজনের নামে রাখেন এটা আমাদের কাছে সব সময়ই বলেন। সরকারি চাকরি করি কখন কি হয় তা তো বলা যায় না। কখন কে আবার ধরে। একই টেবিলে দীর্ঘ ২২ বছর যাবত কাজ করছেন আব্দুল মোমিন। তার বিষয়ে অনেক অভিযোগ থাকলেও কোন ব্যবস্থা নেয়নি কর্তৃপক্ষ।
এসব অভিযোগের বিষয়ে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে আব্দুল মমিনকে পাওয়া যায়নি।
এই বিষয়ে রাজউকের চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার মো: রিয়াজুল ইসলাম বলেন, বর্তমানে রাজউকের বেশকিছু কর্মচারির মামলা হাইকোর্ট দেখছেন। পাশাপাশি দুদকও খোজ-খবর নিচ্ছেন। আমার মতে কোন অনিয়ম করা ঠিক না। যারা করবে তারা আইনের আওতায় আসবে। আইন তাদের বিচার করবে। যেহেতু এখনো তদন্ত চলছে এর বাহিরে আর কিছু বলা যাবে না।